শুক্রবার, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

শিশুশ্রম বন্ধে প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ

আজকের কুমিল্লা ডট কম :
ডিসেম্বর ২, ২০১৭
news-image

ডেস্ক রিপোর্ট :

আমাদের দেশে শিশুশ্রম বন্ধে যে আইন রয়েছে, বাস্তবে তার কোনো প্রয়োগ না থাকায় দেশের অধিকাংশ মা-বাবা তাদের সন্তানদের লেখাপড়া বাদ দিয়ে সাংসারিক বা পারিবারিক কাজে নিয়োগ করেন। এ কারণে দেশের মোট জনসংখ্যার একটা বিশাল অংশ শিক্ষার বাইরে থেকে যায়। এতে দিন দিন দেশে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিশু প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নানা ধরনের কাজে বা শ্রমে নিয়োজিত। ঝুঁকিপূর্ণ শিশু শ্রমিকের সংখ্যা কমলেও প্রকৃত অর্থে এখনও শিশু শ্রমিকের সংখ্যা কমেনি। ১৮টি খাতে এখনও দেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী ৩৪ লাখ ৪৫ হাজার শিশু কর্মরত, যাদের মধ্যে ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত আছে বলে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্যে জানা গেছে। এদিকে সরকার এখন এ শিশুশ্রম বন্ধে ৮৭৮ কোটি ৫৭ লাখ ৫৮ হাজার টাকা ব্যয়ে ৩ বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর উদ্দেশ্য হলো ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম-সংশ্লিষ্ট খাত থেকে ১ লাখ শিশুশ্রমিককে প্রত্যাহার করে নেয়া।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শিশুশ্রম জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৫ থেকে ৭ বছরের শিশুর সংখ্যা ৩ কোটি ৯৬ লাখ ৫২ হাজার ৩৮৪, যার মধ্যে কর্মক্ষম শিশুর সংখ্যা হলো সাড়ে ৩৪ লাখ এবং যাদের বয়স ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সের মধ্যে। এদের মধ্যে আবার ১৭ লাখ শিশু রয়েছে, যাদের কাজ শিশুশ্রমের আওতায় পড়েছে। বাকি শিশুদের কাজ অনুমোদনযোগ্য। আর প্রায় ১৩ লাখ ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত। এসব শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত থাকায় তাদের শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে; শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে- যা দেশের সংবিধানের মৌলিক ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, মোট কর্মক্ষম শিশুর মধ্যে গ্রামীণ এলাকায় ২৪ লাখ ৭০ হাজার, শহরে ৫ লাখ ৭০ হাজার এবং সিটি করপোরেশনে ৪ লাখ ৩০ হাজার। এদের মধ্যে ছেলেশিশু ২১ লাখ এবং মেয়েশিশুর সংখ্যা সাড়ে ১৩ লাখ। এসব শিশু শ্রমিক কাজ করছে বাসাবাড়িতে, কৃষিতে, উৎপাদনমুখী শিল্পে, নির্মাণ শিল্পে, খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়, পরিবহনে। কৃষিতে ৩৬.৯ শতাংশ, উৎপাদনমুখী শিল্পে ২৭.৩ শতাংশ, বন বিভাগ, মৎস্য খাতে ২৭.৪৬ শতাংশ, ১৭.৩৯ শতাংশ কাজ করছে সেবা ও পণ্য বিক্রিতে। তবে বিবিএসের ২০০৩ সালের জাতীয় শিশুশ্রম সমীক্ষায় দেখা গেছে, তখন প্রায় ৭৪ লাখ কর্মরত শিশু ছিল। তাদের মধ্যে ৩১ লাখ ৭৯ হাজার শিশুর কাজ শিশুশ্রমের আওতায় ছিল। তবে এক দশকের ব্যবধানে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা কমেছে মাত্র ১১ হাজার। ২০০৩ সালে দেশে ১২ লাখ ৯১ হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ছিল।
এদিকে ১৮তম আন্তর্জাতিক শ্রম পরিসংখ্যানবিদদের সম্মেলন, বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ এবং ২০১৩-এর সংশোধন অনুসারে কর্মরত শিশু বলতে বোঝায়, ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে যারা সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টা পর্যন্ত হালকা পরিশ্রম বা ঝুঁকিহীন কাজ করে। এ শ্রম অনুমোদনযোগ্য। আর ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী কোনো শিশু যদি কোনো ধরনের ঝুঁকিহীন কাজও করে, তবে তা শিশুশ্রম হবে। ওরাও কর্মরত শিশুদের মধ্যে পড়ে যায়। অন্যদিকে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী কেউ যদি সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টার বেশি কাজ করে, তা ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম হিসেবে স্বীকৃত।
সরকারের নেয়া নতুন কর্মসূচি হিসেবে চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২০ হাজার শিশু, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩০ হাজার, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩০ হাজার এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ২০ হাজার শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করা হবে। এ প্রকল্পটির কাজ দেশের ১৪টি জেলায় বাস্তবায়ন করা হবে। আর সেগুলো হলো কুমিল্লা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট, বরিশাল, রংপুর, রাজশাহী, খুলনা, ঢাকা ও চট্টগ্রামে।
সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, বাংলাদেশ সরকার, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা এবং অংশগ্রহণের মাধ্যমে এরই মধ্যে দেশের তৈরি পোশাক খাত ও চিংড়ি রফতানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকাগুলো পুরোপুরিভাবে শিশুশ্রমমুক্ত করা সম্ভব হয়েছে। তারা স্বীকার করছেন, কৃষিসহ বিভিন্ন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে অনেক শিশু শ্রমিক হিসেবে এখনও নিয়োজিত রয়েছে।
দেশে শিশুশ্রম কমছে, তবে তা প্রত্যাশিত নয়। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দরিদ্র এবং সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য বিভিন্ন উন্নয়নমুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন হলেও শিশু শ্রমিকের সংখ্যা উদ্বেগজনক অবস্থায় রয়ে গেছে। শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে অল্প বয়সী এসব শিশু অমানবিক পরিশ্রম করছে। এ শ্রম বন্ধে কঠোর আইন থাকলেও তার প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন না থাকায় শিশুশ্রম বন্ধ করা যাচ্ছে না। শিশুশ্রম বন্ধে একটি শক্তিশালী কমিশন গঠন করে জোরালোভাবে তা পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। যারা শিশুদের শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করে, তাদের সচেতন করতে মন্ত্রণালয় থেকে নোটিশ জারি করতে হবে। জাতীয় শিশুনীতিতে এটা স্বীকার করা হয়, অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে শিশুরা নানা শ্রমে নিয়োজিত হয়। এক্ষেত্রে গ্রাম-শহরের কোনো ভেদ নেই।
শিশুশ্রম বন্ধে সরকারের পাশাপাশি দেশের সচেতন মহলকে এগিয়ে আসতে হবে। যেসব কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান শিশুদের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করে, তাদের ব্যাপারে সবার আগে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে দেশের প্রতিটি মা-বাবাকে তাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কাজে নিয়োগ না করে বিদ্যালয়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রামের চেয়ে শহরে বেশিরভাগ শিশুশ্রম দেখা যায়। তার কারণ আর্থিক দুরবস্থা। তাছাড়া সেখানে তাদের দেখাশুনা করার মতো কোনো সচেতন লোক না থাকায় তারা বিদ্যালয়গামী না হয়ে শিশুশ্রমসহ বিভিন্ন অসামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে।

আর পড়তে পারেন